এই লভিনু সঙ্গ তব সুন্দর হে সুন্দর….
রবীন্দ্রনাথের লেখা এই অপূর্ব গানটির
অন্তরাতে
এই তোমারি পরশরাগে
চিত্ত হল রঞ্জিত,
এই তোমারি মিলনসুধা
রইল প্রাণে সঞ্চিত।…
এখানে রয়েছে খুব মূল্যবান কয়েকটি
কথা….
সুন্দরের সঙ্গ তখনই অন্তরকে ” ধন্য ”
করে
যখন সেই সুন্দরতার সঙ্গে এসে মেশে
” পরশরাগ “।
চিত্ত রঞ্জিত হলে তবেই,
সেই
সময়ের স্মৃতি চিরকালের জন্য প্রাণে
সঞ্চিত থেকে যায়।
ভালোবাসা, আন্তরিকতা
ছাড়া কোন উৎসব, কোন
পূজা-অনুষ্ঠানের স্মৃতি মনের ভেতরে
স্থায়ী জায়গা করতে পারে না।
তা সে যত বড়
EVENT MANAGER কে দিয়ে
Organized করা অনুষ্ঠানই হোক না
কেন…
সেই অনুষ্ঠানে চমক থাকলেও প্রাণ
থাকেনা, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
আজকাল যৌথ বাড়ি,
যৌথ পরিবার…. এসব
শব্দ গুলোর ব্যাবহার খুব-ই
কমে এসেছে।
এখনকার
যুগ ফ্ল্যাট বাড়ির /আবাসনের যুগ।
কার ফ্ল্যাট কত BHK, তা নিয়ে নিরন্তর
আলোচনা চলতে প্রায়শই দেখা যায়।

আমি যৌথ বাড়িতে
জীবনের কিছুটা সময় কাটিয়ে এসেছি
বলে,
ফ্ল্যাট বাড়ির
” যৌথ ভাবে থাকা ”
আর যৌথ পরিবারে একসাথে থাকার
মধ্যে আকাশ- পাতাল তফাৎ রয়েছে
বলে আমার
মনে হয়।
ফ্ল্যাটে থাকার অজস্র সুবিধা থাকলেও
ফ্ল্যাটে থাকা আর
কোন হোটেলে
রুম বুক করে থাকা
আমার কাছে একই রকম মনে হয়।
পাশের ফ্ল্যাটের কোনো
গুরুত্বপূর্ণ খবর অনেকসময় সম্পূর্ণ
অজানা থেকে যায়,
এমন কথা আমি শুনেছি।
ফ্ল্যাট বা আবাসনের পূজাতে
জাঁক-জমক ও চমক থাকলেও কেমন যেন
” প্রাণহীণ “
বলে আমার মনে হয়।
সকলে একসাথে মিলিত হলেও সেখানে
” পরশরাগ “,
যা চিত্তকে
রঞ্জিত করে তার
বড়-ই অভাব!
সোজা কথায়,
আবাসনের পূজা যৌথ ভাবে করা হলেও
তাতে পারস্পরিক
ভালোবাসা-আন্তরিকতার ছোঁয়ার
অভাব খুব বেশি করে চোখে পড়ে।
সমস্ত ব্যাপারটাই কেমন যেন
TECHNICAL !
মাধবী তলার দে-বাড়িতে
আমার দীর্ঘ
ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে আসার সময় আমার
খুব মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল।
সেই মনখারাপের রেশ অনেক দিন ছিল।

” দে-বাড়ি “।
মাধবী তলা রোড, চুঁচুড়া।

বলরাম গলি ও শীল গলির সংযোগস্থলে থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে
এই বাড়ি।
আমার পিতৃপুরুষ শ্রী
ক্ষেত্রনাথ দে
লাল দাদা
কলকাতার
পোস্তা থেকে চুঁচুড়ার
মাধবীতলায় এই বাড়িতে চলে আসেন।
এই বাড়ি তাঁর

মামার বাড়ি ছিল,
সেই মামারবাড়ীতে এসে
তিনি স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু
করেন।
ক্ষেত্রনাথ দে ও তাঁর ভাই
বাড়ির দুটি অংশে থাকতেন।
দুটি বাড়ি পাশাপাশি
কিন্তু
সদর দরজা আলাদা।
যদিও উঠোনের দরজা দিয়ে
এ-বাড়ি থেকে ও-বাড়ি যাওয়ার ব্যাবস্থা আছে।
ঐ বাড়িতে এখন
দেবু দাদা ,তারকাকুরা থাকে।
ক্ষেত্রনাথ দের আমল থেকেই বাড়িতে নারায়ণ ও
লক্ষীপূজা হয়ে আসছে,
আর বাড়িতে নারায়ণ থাকার কারণে আমাদের বাড়িতে তখনকার দিনে
মুরগির মাংস/ CHICKEN প্রবেশ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ছিল।
বাড়িতে ছবি তোলা বা
FAMILY PHOTOGRAPH
তোলা একটা বড় Event
ছিল বলে আমার মনে হয়।
বাড়ির
ছোটছেলে- মেয়েদের
ও বড়দের
একসাথে গ্রুপ
ফটো তোলার রেওয়াজ
ছিল।

ছোটকা-নন্টুকাকু-বুড়োকাকু,
ছোটকা-বুড্ডিপিসি,হুঁকুজেঠু, জগুজেঠু ও ছোটকা
গাতুপিসি-সুজিতকাকু
ইত্যাদি ছবিগুলি দেখলে
গ্রূপ ফটো তোলার ব্যাপারটা খুব স্পষ্ট ভাবে বোঝা যায়।
বাড়ির উঠোন-দালান
অন্নপূর্ণা পূজার সময়
গমগম করলেও অন্যান্য পূজা পার্বণেও সকলে একসাথে হতাম।
যথা, দোল,
যথা কালিপূজা।
দোলের পূজা দোলের পরেরদিন অর্থাৎ হোলির
দিন হোতো।
দোলের দিন জলরং খেলা
হলেও হোলির দিন শুধু ফাগ খেলা হোতো।
তুতু দিদি-শম্পা দিদিরা
দোলের দিন
Correct Time-এ
আমাদের বাড়ি চলে আসতো।
তুতু দিদির বাড়ি একটু
দূরে হওয়ার জন্য
ও
নীল রঙের ছোট্ট সাইকেলটা ব্যাবহার
করত।
কালী পূজা মানেই
ছোটকার বাজি তৈরি।
ছোটকার বাজি তৈরির
কর্মশালার
Permanent Staff ছিলাম।
আমি, লাল দাদা,
দেবু দাদা ।
সোমা দিদিকে
কাকা
বেশী করে অঙ্কের
Home Task দিয়ে দেবার
জন্য ওর মাঝে মাঝে
একটু Late Attendance
হয়ে যেত।
এই বাজী তৈরীর সময়, রংমশাল
Test করতে গিয়ে
দেবু দাদার হাতে
রংমশাল Burst করে
সাংঘাতিক কান্ড হয়েছিল!!
দেবুদাদাকে
অনেকদিন ভুগতে হয়েছিল।
যাইহোক, ছোটকার
তৈরী রংমশাল
দীপাবলির দিন লক্ষী পূজার সময় পোড়ানো হোতো।
রাশুজেঠু ওঁর পুত্র, লাল দাদাকে নিয়ে 🎆 বাজির বাজার করতে যেতেন।
ভোলা কাকুর দোকান থেকেই দে বাড়ির বাজি আসত।
ছোটকা-রিনিদিদি-লালদাদা
এরা সকলে উঠোনে বাজি
পোড়াতো।
Badminton-খেলা
দালান-উঠোনের একটা
বড় Event হয়ে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৮৩-৮৪ সাল থেকে।
শেলী দিদি , গুল দিদির
আলাদা আলাদা
Badminton Racket
ছিল।
লাল দাদা- রিনিদিদি
একসাথে দুটো খুব সুন্দর
Badminton Racket
কিনেছিল।
আমাকেও বাবা একট
Badminton Racket
কিনে দিয়েছিল।
Badminton খেলতে আমার খুব ভালো লাগতো।
লাল দাদা অতিরিক্ত CHUBS মারার জন্য আমি
ওর সাথে বেশী খেলতে চাইতাম না।
আমি
রিনিদিদির সাথে খেলতে বেশী পছন্দ করতাম।
রিনিদিদি দারুণ জমিয়ে
Badminton খেলতো।
শম্পা দিদিকে খেলতে
ডাকার জন্য আমাদের ভেতর বাড়ীর তিনতলার
ঘরে গেলেই হোতো।
তিনতলার ঘর থেকে শম্পা দিদিদের বাড়ির বারান্দা দেখা যেত।
ঐ বারান্দা থেকে সরাসরি ভেতর বাড়ীর তিনতলার ঘরের সাথে কথাবার্তা
আদান-প্রদান করা যেত।
সবশেষে, আসি অন্নপূর্ণা পূজো প্রসঙ্গে।
১৯৬২ সাল নাগাদ
দে পরিবারে
অন্নপূর্ণা পূজো শুরু হয়।
অন্নপূর্ণা পূজার কথা উঠলেই
জগুজেঠুর কথা খুব মনে পড়ে যায়।
পূজা শুরু হওয়ার
বহুদিন আগে থেকে ঠাকুরের চালচিত্র
তৈরী শুরু হয়ে যেত।
মিলি দিদি ও রিনিদিদি
নিয়মিত জগুজেঠুর বাড়ি
গিয়ে খুব যত্ন নিয়ে
ঠাকুরের চালচিত্র
তৈরী করতো।
পরে
জগুজেঠু অত্যন্ত সাবধানে ও যত্নসহকারে সেই চালচিত্র,
ঠাকুর আসার আগে ঠাকুর ঘরে স্থাপণ করতেন।
মা অন্নপূর্ণার বিভিন্ন গহনা বাড়ির বিভিন্ন পরিবারে থাকত। আমাদের ভিতর
বাড়িতে থাকত শিবের ত্রিশূল ইত্যাদি।
জগুজেঠু ঠাকুরের পূজার ফুল কলকাতা থেকে নিয়ে আসতেন বলে শুনেছি।
জেঠু/শেলী দিদি/গুলদিদির বাড়ির ঠাকুর ঘরের সামনে মায়ের ভোগরান্নার ভিয়েন হোতো।
মালপো ও অন্যান্য মিষ্টি
ওখানেই তৈরী হোতো।
জেঠিমা/ বড়মার
ভাইয়েরা….
শুভঙ্করমামা, দীপঙ্করমামা
সন্দীপমামা এঁরা সকলেই আসতেন।
জেঠিমার
ছোট্ট ভাই
পার্থ-ও আসত।
লাল দাদা তখন
নব্যতরুণ।
কিন্তু,
লাল দাদা অন্নপূর্ণা পূজার
Junior Volenteer ছিল।
পূজার সময় এতো ভীড় হোতো যে দালানে দাঁড়ানো
প্রায় অসম্ভব ছিল।
পূজার আরতির পর পঞ্চপ্রদীপের শিখা
সকলের কাছে নিয়ে যেতেন
কনেদাদু/বড়দাদু।
অন্নপূর্ণা পূজার আগের
দিনের যে দুটি অনুষ্ঠানের
স্মৃতি আমার মনে স্থায়ী জায়গা দখল করে নিয়েছে,
তা হোলো
১৯৮২ সালে
প্রদীপ কাকুর
পরিচালনায় রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য
শাপমোচন ও
১৯৮৬ সালে
দীপশ্রী গঙ্গোপাধ্যায়ের
পরিচালনায়
নৃত্যানুষ্ঠান।
১৯৮১ সালে রবীন্দ্রনাথের
শ্যামা নৃত্যনাট্য আমার দেখা হয়নি।
খুব Miss করে গেছিলাম।
প্রদীপ কাকু
রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী
অশোকতরু বন্দোপাধ্যায়ের ছাত্র ছিলেন।
ওঁর কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান
” সেদিন দুজনে “
দারুণ ভালো লেগেছিল।
ঐ গানের Choreography Arrangement-ও
প্রদীপকাকুর-ই ছিল
” সেদিন দুজনে “
গানের নৃত্যে
অরুণেশ্বর ও কমলিকার ভূমিকায় ছিলো
শেলী দিদি আর
মিলি দিদি।
ঐ গানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটু মায়াময় পরিবেশ তৈরির জন্য একটি
ছোট যন্ত্র উঠোনের
মাঝে প্যান্ডেলে বসানো হয়েছিল।
তাই থেকে ঝিকিমিকে
আলো সারা উঠোনময় ছড়িয়ে পড়ছিল। সে এক দারুণ অভিজ্ঞতা।
১৯৮৬-তে রে নৃত্যানুষ্ঠান হয়েছিল তার Theme ছিল
Spiritual।
মা অন্নপূর্ণা, দূর্গা ইত্যাদি দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছিল নৃত্যের মাধ্যমে।
শেলী দিদি, মিলি দিদি, দীপু দিদি সকলের নাচই আমার খুব ভালো লেগেছিল।


ঐ অনুষ্ঠানে যে দুজনের
গান আমার মন ছুঁয়ে গেছিল, তাঁরা হলেন
রিনিদিদি এবং ভানু-দা।
আকাশবাণী কলকাতার
জনপ্রিয় প্রভাতী অনুষ্ঠান
মহিষাসুরমর্দিনীতে যে
গানটি কোরাসে গাওয়া
হয়েছে, সেটা রিনিদিদির
কন্ঠে SOLO ছিল।
খুব শক্ত গান।
সংস্কৃত উচ্চারণ খুব ভালো করে রপ্ত না করলে এ গান গাওয়া খুব কঠিন।
রিনিদিদি দারুণ সুন্দর ভাবে গানটি গেয়েছিল।
” অন্ন দে মা অন্নপূর্ণা ” গানটি
ভানু-দা দারুণ গেয়েছিলেন। ভানুদা
দীপুদিদির চেনা-পরিচিত
মানুষ।
অন্নপূর্ণা ঠাকুর বিসর্জনের সময় জগুজেঠু হ্যাজাক
জোগাড় করে আনতেন।
অন্নপূর্ণা ঘাটে
কাকা/প্রকাশ কাকু, জগুজেঠু, বড়জেঠু/অরুণ কাকু ইত্যাদি…..বড়দের
সাথে লাল দাদাও জলে নেমে পড়তো।
ঠাকুর ভাসানের পর
ঐ ভ্যান রিক্সা করে
অন্নপূর্ণা-মা-কি জয়….
আসছে বছর আবার হবে…
বলতে বলতে আসার
সময়
আসছে বছর আবার হবে বলার পরক্ষণেই
লাল দাদা ফুট কাটতো
হবেতো????…….
এত বর্ণময় রঙীন অতীত
যা যৌথ পরিবারে স্মৃতিতে
সঞ্চিত হয়
ফ্ল্যাট বাড়িতে তেমনটা হয় কি?
Very Tricky Question.
Leave a comment